রাতে ঘুমানোর আগে আমল: সুন্নত অনুযায়ী করণীয় ও এর ফজিলত
ঘুম মানুষের দৈনন্দিন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের শুধু কীভাবে ঘুমাতে হবে তাই বলেননি, বরং ঘুমানোর আগেও কী কী আমল করলে তা দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য কল্যাণকর হবে, তাও আমাদের শিখিয়েছেন। রাতে ঘুমানোর আগে কিছু আমল ও দোয়া রয়েছে, যেগুলো পালন করলে আত্মিক প্রশান্তি, গুনাহ মাফ এবং শয়তান থেকে হেফাজত লাভ হয়।
১. ওযু করে ঘুমানো
হাদিসের ভিত্তি:
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“যখন তুমি শয়ন করতে যাও, তখন ওযু কর, যেমন নামাজের জন্য ওযু করো।”
(সহীহ বুখারী: ২৪৭)
উপকারিতা:
- মৃত্যুর সময় ওযু অবস্থায় থাকলে এটি ঈমানের নিদর্শন।
- ফেরেশতারা রাতে ওযু অবস্থায় ঘুমানো ব্যক্তির জন্য দোয়া করে।
২. আয়াতুল কুরসী পাঠ
ফজিলত:
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত:
“যে ব্যক্তি ঘুমাতে যাওয়ার আগে আয়াতুল কুরসী পাঠ করে, সে সারা রাত আল্লাহর হেফাজতে থাকে এবং শয়তান তার কাছে আসে না।”
(সহীহ বুখারী: ২৩১১)
পাঠের নিয়ম:
রাতে ঘুমানোর আগে ১ বার আয়াতুল কুরসী পাঠ করে ঘুমানো সুন্নত।
৩. তিন কুল (সূরা ইখলাস, ফালাক, নাস) পড়া
ফজিলত:
আয়েশা (রা.) বলেন:
“প্রতিটি রাতে নবী (সা.) তার হাতের তালুতে সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক এবং সূরা নাস পড়ে ফুঁ দিতেন এবং সারা শরীরে হাত বুলাতেন।”
(সহীহ বুখারী: ৫০১৭)
কিভাবে পড়বেন:
১ বার করে তিনটি সূরা পড়ে দুই হাতের তালুতে ফুঁ দিয়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত হাত বুলাবেন। এটি ৩ বার করা উত্তম।
৪. সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবার
আমল:
হজরত আলী (রা.) ও ফাতিমা (রা.) কে রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘুমের আগে এই তাসবিহ পাঠ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন:
- ৩৩ বার – সুবহানাল্লাহ
- ৩৩ বার – আলহামদুলিল্লাহ
- ৩৪ বার – আল্লাহু আকবার
ফজিলত:
“এটি তোমাদের জন্য একজন খাদেমের চেয়েও উত্তম।”
(সহীহ বুখারী: ৩৭০৫)
৫. ঘুমের দোয়া
মূল আরবি দোয়া:
اللَّهُمَّ بِاسْمِكَ أَمُوتُ وَأَحْيَا
বাংলা উচ্চারণ:
“আল্লাহুম্মা বিসমিকা আমুতু ওয়া আহইয়া”
অর্থ:
হে আল্লাহ! আমি আপনার নামেই মারা যাই এবং জীবিত হই।
হাদিস:
নবী করীম (সা.) এই দোয়াটি ঘুমানোর সময় পাঠ করতেন।
(সহীহ বুখারী: ৬৩২৪)
৬. দিনভর গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা
আমল:
ঘুমানোর আগে একান্তভাবে আল্লাহর কাছে নিজের গুনাহের জন্য ক্ষমা চাওয়া উচিত। ইসতেগফার বলা একটি প্রিয় আমল।
দোয়া:
আস্তাগফিরুল্লাহ আল্লাযি লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়্যুল কাইয়্যুম ওয়া আতুবু ইলাইহি।
৭. ডান কাতে ঘুমানো ও ডান হাতে মাথা রাখা
হাদিসে এসেছে:
রাসুল (সা.) ডান কাতে ঘুমাতেন এবং ডান হাতের তালু গালের নিচে রাখতেন।
“যখন তুমি বিছানায় যাবে, তোমার ডান দিকে শুয়ে পড়ো এবং এই দোয়াটি বলো…”
(সহীহ মুসলিম: ২৭১০)
৮. ঘর পরিষ্কার ও আলো-আগুন চেক করে ঘুমানো
হাদিস:
“তোমাদের ঘরবাড়িতে আগুন রেখে ঘুমিও না।”
(সহীহ বুখারী: ৫৬৭২)
ঘুমানোর আগে গ্যাস, আগুন বা বৈদ্যুতিক ঝুঁকি আছে এমন কিছু দেখে রাখাও ইসলামের শিক্ষার অংশ।
৯. আত্মসমালোচনামূলক চিন্তা
ঘুমানোর আগে নিজের দিনটি রিভিউ করা, কী ভালো করেছি, কী গুনাহ করেছি, কী করতে পারতাম – এসব ভাবা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটি অন্তরের পরিশুদ্ধির একটি প্রক্রিয়া।
উপকারিতা ও ফজিলত সমূহ
আমল | ফজিলত |
---|---|
ওযু করে ঘুম | ফেরেশতা হেফাজত করে |
আয়াতুল কুরসী | শয়তান থেকে নিরাপদ |
তিন কুল | জাদু ও বদনজর থেকে রক্ষা |
তাসবিহ | রূহানী শক্তি অর্জন |
ঘুমের দোয়া | সুন্নতের অনুসরণ |
ইসতেগফার | গুনাহ মাফ |
আত্মসমালোচনা | আত্মশুদ্ধি |
উপসংহার
রাতে ঘুমানোর আগে কিছু ছোট ছোট আমল আমাদের জীবনে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। এগুলো যেমন আমাদের রূহানী জীবনকে সমৃদ্ধ করে, তেমনই দৈহিক ও মানসিক শান্তি নিয়ে আসে। রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের এসব আমল করে ঘুমাতে শিখিয়েছেন যেন আমরা সুরক্ষিতভাবে ঘুমাতে পারি এবং মৃত্যুর মতো ঘুম থেকেও কল্যাণ নিয়ে জেগে উঠি।
আসুন, এই আমলগুলো নিয়মিতভাবে পালন করি, নিজের আত্মা, শরীর এবং ঈমানের যত্ন নেই।