মেয়েরা কি অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া বিয়ে করতে পারে? জানুন ইসলামিক ও আইনি দৃষ্টিকোণ
বাংলাদেশে এবং বিশ্বের অনেক দেশেই বিয়ে একটি সামাজিক এবং ধর্মীয় দায়িত্ব। এটা একজন নারী এবং পুরুষের জীবনযাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, যা সমাজ, ধর্ম, এবং সংস্কৃতির ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের সমাজে, বিশেষত মুসলিম পরিবারে, বিয়ের ক্ষেত্রে অভিভাবকের অনুমতি অনেক গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। তবে প্রশ্ন হলো, যদি মেয়ে তার অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই বিয়ে করতে চায়, তাহলে কি সেটি সম্ভব? এর উত্তর সমাজ, ধর্ম, আইন এবং ব্যক্তিগত অধিকার অনুযায়ী ভিন্ন হতে পারে। চলুন, এই বিষয়ে বিশদ আলোচনা করা যাক।
১. সমাজে বিয়ে এবং অভিভাবকের ভূমিকা
বাংলাদেশের সমাজে, বিয়ে একটি পরিবারের ইস্যু হিসেবে দেখা হয়। পরিবারগুলো সাধারণত বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়, এবং মেয়েটির পরিবার প্রায়শই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঐতিহ্যগতভাবে, মেয়েরা বিয়ের সিদ্ধান্তে তাদের পিতামাতার অনুমতির ওপর নির্ভরশীল। এটি সামাজিক রীতি, সংস্কৃতি, এবং নিরাপত্তা ভাবনা থেকে উদ্ভূত। তবে আধুনিক সমাজে কিছু মেয়ে তাদের স্বাধীনতা চায় এবং তাদের বিয়ের সিদ্ধান্তে একমাত্র নিজেদের মতামতকেই গুরুত্ব দিতে চায়।
২. ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ
বাংলাদেশে অধিকাংশ মানুষ মুসলিম, এবং ইসলাম ধর্মে বিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় কর্তব্য। ইসলাম ধর্মে বিয়ের অনুমতি প্রাপ্তির জন্য কিছু শর্ত রয়েছে। মেয়েদের জন্য এই শর্তগুলি তার অভিভাবকের অনুমতি বা আপত্তি নিয়ে সম্পন্ন হতে পারে। তবে ইসলাম ধর্মে এটি স্পষ্ট যে, যদি মেয়ে নিজেকে সঠিকভাবে নির্বাচন করতে সক্ষম হয় এবং তার পছন্দের ব্যক্তি তার ধর্মীয় ও নৈতিক আদর্শের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়, তাহলে অভিভাবকের অনুমতি প্রয়োজন নয়।
ইসলামে মেয়েদের জন্য একটি বিশেষ বিধান আছে, যা “ইজাব-কবুল” নামে পরিচিত। এর মাধ্যমে, মেয়েটি নিজেকে একজন পুরুষের সাথে বিয়ে করতে সম্মতি দেয়। এটি একটি স্বতন্ত্র আইনি পদক্ষেপ এবং মেয়েটি তার স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তবে, ইসলামের অনুসারী সমাজে, একটি বিয়ে সাধারণত পরিবারের সম্মতি এবং অভিভাবকের অনুমতির মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।
৩. বাংলাদেশের আইনগত দৃষ্টিকোণ
বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, নারী ও পুরুষের বিয়ে করার ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম ও শর্ত রয়েছে। ১৯৭৪ সালের “মুসলিম মেয়েদের বিয়ে আইন” অনুযায়ী, ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েরা বিয়ে করতে পারবেন না, তবে ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে মেয়েরা তাদের অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াও বিয়ে করতে পারবেন।
তবে, এখানে একটি বড় প্রশ্ন ওঠে: এটা কি নারী স্বাধীনতার সঙ্গতিপূর্ণ? স্বাধীনভাবে বিয়ে করার অধিকার নারীর কাছে হওয়া উচিত, এবং তার সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা উচিত। অনেক নারী অধিকার সংস্থার মত অনুযায়ী, যেহেতু একজন নারী তার নিজ জীবনের অধিকারী, তাই তার স্বাধীন ইচ্ছায় বিয়ে করার অধিকার থাকা উচিত। এক্ষেত্রে, একজন মেয়ে তার অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই বিয়ে করতে পারেন, যদি তিনি আইনগতভাবে প্রাপ্তবয়স্ক হন এবং তার পছন্দ ও সিদ্ধান্ত সঠিক হয়।
৪. পরিবার এবং সমাজের মতামত
যদিও বাংলাদেশের আইনে মেয়েরা ১৮ বছর বয়সের পর তাদের বিয়ে করার স্বাধীনতা লাভ করে, তবে সমাজে অনেকেই মনে করেন যে, মেয়েরা তাদের অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই বিয়ে করতে পারবে না। এটি সাধারণত সমাজের নিয়মকানুন এবং সংস্কৃতির অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। অধিকাংশ পরিবার, বিশেষত গ্রামীণ এলাকায়, বিয়ে একটি পরিবারিক বিষয় হিসেবেই দেখে, যেখানে অভিভাবকের মতামত সর্বাধিক গুরুত্ব পায়।
বিভিন্ন সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বাধা, যেমন পরিবার ও সমাজের সম্মান, মেয়েদের অভিভাবকদের অনুমতির ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়। সমাজে অনেক ক্ষেত্রে মেয়েদের স্বাধীনতা এখনও সঠিকভাবে গ্রহণ করা হয়নি, এবং বিশেষ করে বিয়ে ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাদের স্বাধীনতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠে।
৫. নারীর অধিকার এবং স্বাধীনতা
বর্তমানে নারীর অধিকার এবং স্বাধীনতা নিয়ে বৈশ্বিক আলোচনা অনেক বেশি। নারীদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা, তাদের পছন্দ ও মতামত যথাযথভাবে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে নারীদের অধিকার নিয়ে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। নারীরা এখন শিক্ষা, চাকরি, এবং সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে আরও অনেক সুযোগ পাচ্ছে।
তবে, বিয়ে সম্পর্কে নারীর স্বাধীনতা এখনও একটি বিতর্কিত বিষয়। কিছু নারীবাদী সংগঠন এবং অধিকার সংস্থাগুলি মনে করেন, মেয়েরা তাদের নিজস্ব জীবনযাত্রার সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা পেতে পারে, এবং তাদের জীবনসঙ্গী নির্বাচন করতে তাদের অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। তারা মনে করেন যে, পরিবার ও সমাজের চাপের কারণে অনেক মেয়ে তাদের পছন্দের জীবনসঙ্গীকে বেছে নিতে পারছে না।
৬. অভিভাবক এবং মেয়ের সম্পর্ক
অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া মেয়ে বিয়ে করতে চাইলে, একটি বড় প্রশ্ন উঠতে পারে তা হলো: মেয়ের অভিভাবকের সঙ্গে তার সম্পর্ক কেমন? সাধারণত, অভিভাবকরা তাদের মেয়ের ভালোর জন্যই তার বিয়ে নিয়ে চিন্তা করে, কিন্তু কখনও কখনও এই সিদ্ধান্ত অভিভাবকের পক্ষ থেকে অত্যাধিক নিয়ন্ত্রণের ফলস্বরূপ হতে পারে। এর ফলে, মেয়ের স্বাধীনতা সীমিত হতে পারে।
অভিভাবকদের উচিত মেয়েকে তার জীবনযাত্রার সিদ্ধান্তে সহায়তা করা, এবং তাকে তার পছন্দ অনুযায়ী জীবনসঙ্গী নির্বাচন করার সুযোগ দেওয়া। যদি মেয়ে একনিষ্ঠভাবে তার পছন্দের সাথে খুশি থাকে, তবে অভিভাবকের উচিত তার পছন্দের প্রতি সম্মান জানানো।
৭. শেষ কথা
অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া কোনো মেয়ে বিয়ে করতে পারবে কি, এই প্রশ্নটির উত্তর সামাজিক, ধর্মীয়, আইনগত এবং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভিন্ন হতে পারে। ইসলামের নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণ এবং বাংলাদেশের আইনের প্রেক্ষাপটে, প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েরা তাদের স্বাধীনভাবে বিয়ে করার অধিকার রাখে। তবে, সমাজের চাপে এবং পরিবারের ঐতিহ্যগত চিন্তাভাবনার কারণে, অনেক মেয়ে অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া বিয়ে করতে সাহস পায় না।
একজন মেয়ের জন্য তার জীবনযাত্রার সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা এবং তার পছন্দের সম্মান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি কোনো মেয়ে অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই বিয়ে করতে চায়, তবে তার নিজস্ব সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সমর্থন প্রদর্শন করা উচিত। এটা নিশ্চিত করবে যে, তার জীবনের পথ তাকে তার ইচ্ছেমতো গড়ে তুলতে পারে।
এমনকি, অভিভাবকরা তাদের মেয়ের সুখ এবং শান্তি নিশ্চিত করার জন্য তাদের ইচ্ছাকে শ্রদ্ধা জানানো উচিত, তবে এটি কখনও তাদের নিরাপত্তা বা নৈতিক ভিত্তির সাথে আপস না করে।
[…] […]