ম্যালেরিয়া কাকে বলে? – রোগ, লক্ষণ, চিকিৎসা এবং প্রতিকার

ম্যালেরিয়া একটি প্রাণঘাতী রোগ যা সাধারণত মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। পৃথিবীজুড়ে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হন, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে। এটি যদি সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না করা হয়, তবে এটি মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তবে, ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণযোগ্য এবং প্রতিরোধযোগ্য একটি রোগ। সঠিক প্রতিকার ও চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে ম্যালেরিয়া থেকে সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব।

এই ব্লগে আমরা ম্যালেরিয়া রোগের সংজ্ঞা, লক্ষণ, চিকিৎসা, ঔষধের নাম এবং প্রতিকার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

ম্যালেরিয়া কাকে বলে?

ম্যালেরিয়া হল একটি জীবাণুবাহী রোগ যা প্লাজমোডিয়াম নামক পরজীবীর কারণে হয়। এই পরজীবী সাধারণত এডিস বা আনফিলেস প্রজাতির মশার মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। মশার কামড়ের মাধ্যমে প্লাজমোডিয়াম পরজীবী রক্তের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে এবং রক্তকণিকা (Red Blood Cells) নষ্ট করতে শুরু করে। এতে রক্তের অভাব, জ্বর, ঠান্ডা, তীব্র মাথাব্যথা, বমি, এবং অন্যান্য উপসর্গ দেখা দেয়।

ম্যালেরিয়া রোগের সবচেয়ে সাধারণ উপসর্গগুলো হলো:

  1. তীব্র জ্বর
  2. ঠান্ডা অনুভূতি
  3. মাথাব্যথা
  4. ক্লান্তি এবং দুর্বলতা
  5. বমি
  6. পেটের ব্যথা

ম্যালেরিয়া রোগের লক্ষণ

ম্যালেরিয়া রোগের লক্ষণগুলি সাধারণত মশার কামড়ের পর ৭-৩০ দিন পর শুরু হয়। তবে, এটি বিভিন্ন ধরনের প্লাজমোডিয়াম পরজীবীর কারণে বিভিন্ন উপসর্গের সৃষ্টি করতে পারে। ম্যালেরিয়ার লক্ষণগুলি সাধারণত নিম্নলিখিত রূপে প্রকাশ পায়:

  1. জ্বর ও ঠান্ডা: ম্যালেরিয়া রোগের সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ হলো তীব্র জ্বর। জ্বরের সঙ্গে ঠান্ডা অনুভূতিও হতে পারে। এটি সাধারণত ৪৮ ঘণ্টা পর পর রিকরিং সাইকেল আকারে ঘটে।
  2. মাথাব্যথা: ম্যালেরিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির মাথায় তীব্র ব্যথা হতে পারে। এটি সাধারণত রোগের প্রথম দিকে দেখা যায়।
  3. ক্লান্তি ও দুর্বলতা: ম্যালেরিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে শক্তি কমে যায় এবং তারা তীব্র ক্লান্তি অনুভব করে।
  4. বমি ও পেটের সমস্যা: অনেক সময় ম্যালেরিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির বমি এবং পেটব্যথা হতে পারে। এটি রোগটির আরও একটি সাধারণ লক্ষণ।
  5. শরীরের ব্যথা: কিছু রোগী শরীরে ব্যথা, বিশেষত পেশীতে ব্যথা অনুভব করতে পারে।
  6. অরবাচ্ছা (Anemia): ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হলে রক্তকণিকা নষ্ট হয়ে যায়, যার ফলে রক্তাল্পতা বা অরবাচ্ছা দেখা দিতে পারে। এটি বিশেষ করে প্লাজমোডিয়াম ফালসিপারাম ধরনের ম্যালেরিয়াতে বেশি ঘটে।

ম্যালেরিয়া রোগের চিকিৎসা

ম্যালেরিয়া একটি মারাত্মক রোগ হলেও এটি সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হয়ে ওঠা সম্ভব। চিকিৎসা শুরু হলে রোগীর অবস্থার দ্রুত উন্নতি ঘটতে পারে। ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা মূলত অ্যান্টিম্যালেরিয়াল ঔষধের মাধ্যমে করা হয়। ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা সাধারণত নিম্নলিখিত উপায়ে করা হয়:

১. অ্যান্টিম্যালেরিয়াল ঔষধ

ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিম্যালেরিয়াল ঔষধ ব্যবহার করা হয়। সাধারণত প্লাজমোডিয়াম ভিভ্যাক্স, প্লাজমোডিয়াম ফালসিপারাম, প্লাজমোডিয়াম ম্যালারিয়ি এবং প্লাজমোডিয়াম ওভালির মতো বিভিন্ন প্রজাতির পরজীবী দ্বারা এই রোগটি হয়। প্রত্যেকটি পরজীবীর জন্য আলাদা আলাদা ঔষধ ব্যবহার করা হয়।

২. প্রধান অ্যান্টিম্যালেরিয়াল ঔষধের নাম

  1. ক্লোরোকুইন (Chloroquine): এটি একটি প্রচলিত অ্যান্টিম্যালেরিয়াল ঔষধ যা বিশেষ করে প্লাজমোডিয়াম ভিভ্যাক্স এবং প্লাজমোডিয়াম ম্যালারিয়ির বিরুদ্ধে কার্যকর।
  2. মেফোকুইন (Mefloquine): এটি ম্যালেরিয়ার চিকিৎসার জন্য আরেকটি কার্যকর ঔষধ। এটি সাধারণত প্লাজমোডিয়াম ফালসিপারাম ও প্লাজমোডিয়াম ভিভ্যাক্সের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়।
  3. আরটেমিসিনিন (Artemisinin): এটি ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় একটি আধুনিক ঔষধ যা প্লাজমোডিয়াম ফালসিপারামের বিরুদ্ধে কার্যকরী।
  4. প্রিমাকুইন (Primaquine): এটি ম্যালেরিয়ার পরবর্তী সময়ে রিকরেন্স রোধ করার জন্য ব্যবহৃত হয়।
  5. হ্যালোফ্যানট্রিন (Halofantrine): এটি ম্যালেরিয়া চিকিৎসায় ব্যবহৃত একটি অন্য ধরনের অ্যান্টিম্যালেরিয়াল ঔষধ।

৩. চিকিৎসার পদ্ধতি

ম্যালেরিয়া রোগের চিকিৎসা প্রাথমিকভাবে ঔষধের উপর নির্ভরশীল। তবে, রোগীকে পূর্ণ বিশ্রাম ও পর্যাপ্ত জলপানও জরুরি। ম্যালেরিয়া আক্রান্ত ব্যক্তি গরম বা ঠান্ডা লাগলে এবং জ্বর অনুভব করলে তাদের ঠান্ডা বা গরম কমানোর জন্য সেবা নেওয়া উচিত।

৪. শ্বাসকষ্ট বা মস্তিষ্কে সমস্যা

ম্যালেরিয়া যদি গুরুতর হয় এবং মস্তিষ্কের বা শ্বাসযন্ত্রের সমস্যার সৃষ্টি হয়, তবে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে আইভি (IV) ঔষধ এবং অন্যান্য সহায়ক চিকিৎসা প্রয়োজন।

ম্যালেরিয়া রোগের প্রতিকার

ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ করার জন্য কিছু সহজ এবং কার্যকর উপায় রয়েছে, যা ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমাতে সহায়ক। এর মধ্যে অন্যতম উপায় হলো মশার কামড় থেকে সুরক্ষা পাওয়া।

১. মশারি ব্যবহার

মশারি ব্যবহার করলে মশার কামড় থেকে সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব। বিশেষ করে রাতে ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মশারি প্রায় ৯০% ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে সহায়ক।

২. মশারি স্প্রে বা লোশন

মশার কামড় থেকে সুরক্ষা পাওয়ার জন্য মশারি স্প্রে বা লোশন ব্যবহার করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে মশার কামড়ের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।

৩. পরিষ্কার পরিবেশ

ম্যালেরিয়া মশা জলাবদ্ধ পরিবেশে বাস করে। তাই ঘরের আশপাশ পরিষ্কার রাখা এবং জল জমে থাকার জায়গাগুলো পরিষ্কার করে ফেলা জরুরি।

৪. অ্যান্টিম্যালেরিয়াল ঔষধের প্রোফিল্যাক্সিস

যাদের ম্যালেরিয়া হওয়ার ঝুঁকি বেশি, তাদের জন্য চিকিৎসকরা প্রোফিল্যাক্সিস (প্রতিরোধমূলক) অ্যান্টিম্যালেরিয়াল ঔষধ ব্যবহারের পরামর্শ দিতে পারেন। বিশেষ করে ম্যালেরিয়া প্রবণ অঞ্চলে ভ্রমণকারীদের জন্য এটি প্রযোজ্য।

৫. ভ্যাকসিন

বর্তমানে ম্যালেরিয়া রোগের একটি ভ্যাকসিনও উন্নয়ন হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে আরও কার্যকর হতে পারে। RTS,S/AS01 ভ্যাকসিনটি কিছু সীমিত সফলতা দেখিয়েছে।

উপসংহার

ম্যালেরিয়া একটি গুরুতর এবং মহামারি রোগ, তবে সঠিক চিকিৎসা, প্রোফিল্যাক্সিস এবং প্রতিরোধের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হলে সময়মতো চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে সুস্থ হয়ে ওঠা সম্ভব। সঠিক উপায়ে মশার কামড় থেকে সুরক্ষা নিয়ে এবং পরিবেশকে পরিষ্কার রেখে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ করা যেতে পারে।

সূত্র:

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।