ভূমিকম্প কেন হয়: কারণ ও প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ

ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যা ভূত্বকের অভ্যন্তরীণ চলাচল ও শক্তি মুক্তির কারণে ঘটে। এটি পৃথিবীর ভূত্বকের প্লেটগুলোর চলাচল, সংঘর্ষ, অথবা বিকৃতির ফলে সৃষ্টি হয়। ভূমিকম্প একটি সাধারণ ঘটনা হলেও এটি কখনো কখনো ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।


ভূমিকম্প কেন হয়

ভূমিকম্প কী?

ভূমিকম্প হলো পৃথিবীর ভূত্বকের আকস্মিক কাঁপুনি বা কম্পন, যা ভূ-গর্ভে শক্তি নির্গত হওয়ার ফলে ঘটে। এই কম্পনের প্রধান কারণ হলো ভূত্বকের প্লেটগুলোর মধ্যে চলাচল ও সংঘর্ষ।


ভূমিকম্পের কারণ

১. টেকটোনিক প্লেটের চলাচল

পৃথিবীর ভূত্বক কয়েকটি বড় টেকটোনিক প্লেটে বিভক্ত। এই প্লেটগুলো ক্রমাগত চলাচল করছে।

  • যখন দুটি প্লেট পরস্পরের সাথে সংঘর্ষ করে, তখন ভূগর্ভে শক্তি সঞ্চিত হয়।
  • এই শক্তি হঠাৎ মুক্ত হলে ভূমিকম্প ঘটে।

২. ফল্ট লাইন (Fault Line)

ফল্ট লাইন হলো ভূত্বকের একটি দুর্বল অংশ, যেখানে দুটি প্লেটের সংযোগ ঘটে।

  • ফল্ট লাইনে সঞ্চিত শক্তি হঠাৎ মুক্ত হয়ে ভূমিকম্প সৃষ্টি করে।
  • উদাহরণ: সান আন্দ্রেয়াস ফল্ট, যা ক্যালিফোর্নিয়ায় ভূমিকম্পের জন্য বিখ্যাত।

৩. জ্বালামুখী অগ্ন্যুৎপাত

জ্বালামুখীর অগ্ন্যুৎপাতের সময় ভূগর্ভের গরম লাভা এবং গ্যাস নির্গত হওয়ার ফলে ভূত্বক কম্পিত হয়।

  • এটি সাধারণত স্থানীয় ভূমিকম্প সৃষ্টি করে।

৪. মানুষের কার্যক্রম

কখনো কখনো মানুষের কার্যক্রমও ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে।

  • খনি খনন
  • বাঁধ নির্মাণ
  • ভূগর্ভে পারমাণবিক পরীক্ষা

৫. ইনট্রাপ্লেট ভূমিকম্প

প্লেটগুলোর অভ্যন্তরেও শক্তি সঞ্চিত হতে পারে, যা ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে। এটি তুলনামূলকভাবে বিরল।


ভূমিকম্পের প্রক্রিয়া (Mechanism)

১. শক্তি সঞ্চয়

ভূত্বকের প্লেটগুলো যখন চলাচল করে, তখন তাদের মধ্যে ঘর্ষণ হয়। এর ফলে শক্তি সঞ্চিত হয়।

২. এলাস্টিক রিবাউন্ড থিওরি

প্লেটগুলো যখন একে অপরের ওপর চাপ সৃষ্টি করে, তখন ভূত্বক বিকৃত হয়।

  • এক পর্যায়ে এই বিকৃতি সহ্যসীমা অতিক্রম করে এবং প্লেটগুলো হঠাৎ সরে যায়।
  • এতে ভূগর্ভে সঞ্চিত শক্তি মুক্ত হয় এবং ভূমিকম্প ঘটে।

৩. কম্পনের ধরণ

ভূমিকম্পের ফলে যে কম্পন সৃষ্টি হয়, তা তিন ধরণের তরঙ্গের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে:

  • প্রাথমিক তরঙ্গ (P-Wave): দ্রুত গতিতে ছড়ায়।
  • দ্বিতীয় তরঙ্গ (S-Wave): ধীরগতির এবং বেশি ক্ষতিকারক।
  • পৃষ্ঠতরঙ্গ (Surface Wave): ভূত্বকের ওপর দিয়ে চলাচল করে।

ভূমিকম্পের পরিমাপ

১. রিক্টার স্কেল

রিক্টার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা পরিমাপ করা হয়।

  • স্কেল ১ থেকে ১০ পর্যন্ত হয়।
  • ৭ বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প বিধ্বংসী।

২. মোমেন্ট ম্যাগনিটিউড স্কেল (Moment Magnitude Scale)

এটি ভূমিকম্পের শক্তি পরিমাপের একটি আধুনিক পদ্ধতি।

৩. মার্সেলি স্কেল (Mercalli Scale)

ভূমিকম্পের প্রভাব বা ক্ষতির পরিমাণ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।


ভূমিকম্পের প্রভাব

১. জীবন ও সম্পদের ক্ষতি

বিধ্বংসী ভূমিকম্পের ফলে মানুষের প্রাণহানি এবং সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

২. সুনামি

যখন ভূমিকম্প সমুদ্রের তলদেশে ঘটে, তখন তা সুনামি সৃষ্টি করতে পারে।

৩. ভূত্বকের পরিবর্তন

ভূমিকম্প ভূত্বকের গঠন পরিবর্তন করতে পারে।


ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল

বিশ্বের কিছু এলাকা ভূমিকম্পপ্রবণ, যেমন:

  1. রিং অব ফায়ার (Ring of Fire)
  2. হিমালয় অঞ্চল
  3. সান আন্দ্রেয়াস ফল্ট (San Andreas Fault)

ভূমিকম্প থেকে সুরক্ষা

১. প্রস্তুতি

  • ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় বাস করলে বিল্ডিং কোড মেনে নির্মাণ করতে হবে।
  • প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র হাতের কাছে রাখতে হবে।

২. ভূমিকম্পের সময় করণীয়

  • শক্ত টেবিল বা আসবাবপত্রের নিচে আশ্রয় নিন।
  • দরজা ও জানালা থেকে দূরে থাকুন।

৩. পরবর্তী পদক্ষেপ

  • বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং পানির সংযোগ পরীক্ষা করুন।
  • আহতদের সহায়তা করুন।

উপসংহার

ভূমিকম্প একটি জটিল প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, যা পৃথিবীর ভূত্বকের গতিবিধি এবং শক্তি মুক্তির সাথে সম্পর্কিত। এটি আমাদের জীবন এবং পরিবেশে গভীর প্রভাব ফেলে। যথাযথ প্রস্তুতি এবং সচেতনতা বাড়িয়ে আমরা ভূমিকম্পের ক্ষতি কমিয়ে আনতে পারি।

সূত্র:

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।