দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কেন হয়েছিল: কারণ ও বিশ্লেষণ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত চলা মানব ইতিহাসের অন্যতম বিধ্বংসী যুদ্ধ। এটি পুরো বিশ্বকে দুই প্রধান শিবিরে বিভক্ত করেছিল: মিত্রশক্তি (Allied Powers) এবং অক্ষশক্তি (Axis Powers)। এই যুদ্ধের পেছনে ছিল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং আদর্শগত বেশ কয়েকটি কারণ।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কেন হয়েছিল

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিণাম

১৯১৯ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে জার্মানির ওপর চাপানো হয় ভার্সাই চুক্তি (Treaty of Versailles)

  1. জার্মানিকে বিশাল পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিল।
  2. তাদের সামরিক বাহিনী সীমিত করা হয়।
  3. অঞ্চল হারানোর ফলে জার্মান জনগণের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়।

এই চুক্তি জার্মানির অর্থনীতি এবং মনোবলে ব্যাপক প্রভাব ফেলে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটি প্রধান কারণ হিসেবে দেখা যায়।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রধান কারণ

১. আদর্শগত দ্বন্দ্ব ও ফ্যাসিবাদের উত্থান

ফ্যাসিবাদ (Fascism) এবং নাৎসিবাদ (Nazism)
  • ইতালিতে বেনিতো মুসোলিনি (Benito Mussolini) এবং জার্মানিতে অ্যাডলফ হিটলার (Adolf Hitler) ফ্যাসিবাদ এবং নাৎসিবাদের প্রচার করেন।
  • এই আদর্শগুলো স্বৈরাচারী সরকার এবং সামরিক আধিপত্যকে উৎসাহিত করে।
  • হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানি তাদের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করে।

২. জাতীয়তাবাদ (Nationalism)

উগ্র জাতীয়তাবাদের ফলে জার্মানি এবং জাপানের মতো দেশগুলো তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারে আগ্রহী হয়।

  • জার্মানি পূর্ব ইউরোপ এবং রাশিয়ার দিকে আগ্রসর হয়।
  • জাপান এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আক্রমণ করে।

৩. মিত্রশক্তি এবং অক্ষশক্তির সংঘর্ষ

বিশ্বের প্রধান শক্তিগুলো বিভক্ত হয়ে পড়ে।

  • মিত্রশক্তি: যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র।
  • অক্ষশক্তি: জার্মানি, ইতালি, জাপান।

৪. মিউনিখ চুক্তি এবং অ্যাপিজমেন্ট নীতি

১৯৩৮ সালে যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্সের নেতারা মিউনিখ চুক্তির মাধ্যমে হিটলারের চেকোস্লোভাকিয়ার সুদেতেনল্যান্ড দখল মেনে নেন।

  • এটি হিটলারকে আরও আগ্রাসী হতে উৎসাহিত করে।
  • এই চুক্তি বিশ্বযুদ্ধের দিকে অগ্রসর হওয়ার একটি প্রধান কারণ।

৫. বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা (Great Depression)

১৯২৯ সালের অর্থনৈতিক মন্দা বিশ্বের অনেক দেশকে দুর্বল করে দেয়।

  • বেকারত্ব এবং দারিদ্র্য বৃদ্ধি পায়।
  • জনগণ চরমপন্থী নেতাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়, যেমন হিটলার।

৬. লিগ অব নেশনসের ব্যর্থতা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর শান্তি রক্ষা করার জন্য লিগ অব নেশনস (League of Nations) গঠিত হয়েছিল।

  • এটি সামরিক আগ্রাসন প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়।
  • মুসোলিনি এবং হিটলারের মতো নেতারা লিগের দুর্বলতাকে কাজে লাগান।

৭. জাপানের সাম্রাজ্যবাদ

জাপান এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারে আগ্রাসী হয়ে ওঠে।

  • ১৯৩১ সালে মাঞ্চুরিয়া দখল।
  • ১৯৩৭ সালে চীন আক্রমণ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা

১. পোল্যান্ড আক্রমণ (১৯৩৯)

১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ সালে জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করে।

  • যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
  • এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সরাসরি সূচনা।

২. সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা

সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং জার্মানির মধ্যে মলোটভ-রিবেন্ট্রপ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

  • তারা পোল্যান্ডকে দুই ভাগে বিভক্ত করে দখল করে।

৩. জাপানের প্রশান্ত মহাসাগরীয় আগ্রাসন

১৯৪১ সালে জাপান পার্ল হারবারে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবহরে হামলা চালায়।

  • এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র মিত্রশক্তিতে যোগ দেয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব

১. বিশ্বব্যাপী ধ্বংসযজ্ঞ

  • প্রায় ৭ কোটি মানুষ মারা যায়।
  • শহর, শিল্প এলাকা ধ্বংস হয়ে যায়।

২. নতুন বিশ্বব্যবস্থা

  • জাতিসংঘ (United Nations) প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে দ্বিধাবিভক্ত হয়।

৩. উপনিবেশবাদ পতন

  • যুদ্ধোত্তর যুগে উপনিবেশগুলো স্বাধীনতা লাভ করে।

উপসংহার

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মূল কারণ ছিল রাজনৈতিক অসন্তোষ, অর্থনৈতিক সংকট এবং বিশ্ব নেতৃত্বের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই। এই যুদ্ধ মানব সভ্যতার জন্য একটি তিক্ত শিক্ষা, যা শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা আরও সুস্পষ্ট করেছে।

সূত্র:

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।