এল নিনো ও লা নিনা: বৈশ্বিক আবহাওয়ার চালিকাশক্তি
পৃথিবীর জলবায়ু ব্যবস্থার জটিলতা ও বৈচিত্র্যের মধ্যে এল নিনো (El Niño) এবং লা নিনা (La Niña) দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক ঘটনা, যা বিশ্বজুড়ে আবহাওয়া, কৃষি, অর্থনীতি এবং জনজীবনের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এই দুটি স্প্যানিশ শব্দ, যার অর্থ যথাক্রমে ‘ছোট্ট ছেলে’ এবং ‘ছোট্ট মেয়ে’, প্রশান্ত মহাসাগরের নিরক্ষীয় অঞ্চলের সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ও বায়ুমণ্ডলীয় চাপের পরিবর্তনকে নির্দেশ করে। এই প্রাকৃতিক চক্রকে সম্মিলিতভাবে এনসো (ENSO – El Niño-Southern Oscillation) বলা হয় এবং এটি আবহাওয়ার একটি স্বাভাবিক অংশ, যা প্রতি ২ থেকে ৭ বছর পরপর চক্রাকারে ফিরে আসে।
এল নিনো ও লা নিনা কী?
এল নিনো হলো এনসো চক্রের উষ্ণ পর্যায়। যখন মধ্য ও পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের নিরক্ষীয় অঞ্চলের সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি বৃদ্ধি পায় এবং এই অবস্থা কমপক্ষে পাঁচ মাস ধরে স্থায়ী হয়, তখন তাকে এল নিনো বলে। এই পরিস্থিতিতে পূর্বমুখী বাণিজ্য বায়ু (Trade Winds) দুর্বল হয়ে পড়ে বা উল্টো দিকে প্রবাহিত হতে শুরু করে, যার ফলে উষ্ণ সমুদ্রের পানি পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে চলে আসে। এর ফলস্বরূপ দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলে (যেমন পেরু ও চিলি) সমুদ্রের গভীর থেকে শীতল, পুষ্টিসমৃদ্ধ পানির উত্থান (Upwelling) ব্যাহত হয়, যা মৎস্যশিল্পের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
অন্যদিকে, লা নিনা হলো এনসো চক্রের শীতল পর্যায়। যখন মধ্য ও পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের নিরক্ষীয় অঞ্চলের সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি হ্রাস পায় এবং এই অবস্থা পাঁচ মাসের বেশি সময় ধরে বজায় থাকে, তখন তাকে লা নিনা বলে। লা নিনার সময় বাণিজ্য বায়ু স্বাভাবিকের চেয়ে শক্তিশালী হয়, যা উষ্ণ পানিকে আরও বেশি করে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের (এশিয়া-অস্ট্রেলিয়া অঞ্চল) দিকে ঠেলে নিয়ে যায় এবং পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে শীতল পানির উত্থানকে তীব্র করে তোলে।
কীভাবে এল নিনো ও লা নিনা আবহাওয়ার উপর প্রভাব ফেলে?
এল নিনো ও লা নিনার প্রভাব বিশ্বজুড়ে আবহাওয়ার বৈচিত্র্য সৃষ্টি করে। এই দুটি ঘটনা বায়ুমণ্ডলীয় চাপ, বৃষ্টিপাত এবং তাপমাত্রার প্যাটার্নকে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন করে।
এল নিনোর প্রভাব:
- তাপমাত্রা বৃদ্ধি: এল নিনো বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এল নিনো বছরে পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রায় ০.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে।
- বৃষ্টিপাত ও খরা: এল নিনোর প্রভাবে সাধারণত পূর্ব ও মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরের আশেপাশে (যেমন পেরু, ইকুয়েডর, চিলি, এবং উত্তর আমেরিকা) বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পায়, যা বন্যা ও ভূমিধসের কারণ হতে পারে। অন্যদিকে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া (ভারত, বাংলাদেশ সহ), অস্ট্রেলিয়া এবং আফ্রিকার কিছু অংশে বৃষ্টিপাত কমে যায়, ফলে খরা ও দাবানলের ঝুঁকি বাড়ে।
- ঘূর্ণিঝড়: এল নিনো আটলান্টিক মহাসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা কমিয়ে দিলেও, পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা এবং তীব্রতা বাড়িয়ে দেয়।
- মৎস্যশিল্পে প্রভাব: দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলে উষ্ণ পানির কারণে পুষ্টিসমৃদ্ধ শীতল পানির উত্থান ব্যাহত হওয়ায় সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য, বিশেষ করে মাছের প্রজনন ও বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা মৎস্যশিল্পে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে।
- কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা: এল নিনোর কারণে খরা ও অতিবৃষ্টির ফলে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যাহত হয়, যা বিশ্বজুড়ে খাদ্য নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলে।
লা নিনার প্রভাব:
- তাপমাত্রা হ্রাস: লা নিনা বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা সামান্য কমাতে সাহায্য করে, কারণ এটি শীতল পানির বিস্তৃতি ঘটায়।
- বৃষ্টিপাত ও বন্যা: লা নিনার প্রভাবে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর (ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) এবং ভারতের কিছু অঞ্চলে বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়, যা বন্যা ও ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়ায়। পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের (যেমন দক্ষিণ আমেরিকা) কাছাকাছি অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কমে যায়।
- ঘূর্ণিঝড়: লা নিনা আটলান্টিক মহাসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ও তীব্রতা বৃদ্ধি করে, কারণ উষ্ণ সমুদ্রের পানি এবং বায়ুমণ্ডলীয় পরিস্থিতি ঘূর্ণিঝড় তৈরির জন্য অনুকূল হয়।
- কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা: লা নিনার প্রভাবে নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে অতিবৃষ্টি ও বন্যা যেমন ফসলের ক্ষতি করে, তেমনি অন্য অঞ্চলে স্বাভাবিক বা অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে।
এল নিনো ও লা নিনার ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত
এল নিনো ও লা নিনা বহুবার বিশ্বজুড়ে বড় ধরনের আবহাওয়াগত বিপর্যয় ঘটিয়েছে।
- ১৯৮২-৮৩ এবং ১৯৯৭-৯৮ সালের এল নিনো: এই দুটি ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী এল নিনো ঘটনা, যা ক্যালিফোর্নিয়া থেকে মেক্সিকো ও চিলি পর্যন্ত ব্যাপক বন্যা সৃষ্টি করেছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় ব্যাপক খরা দেখা দেয়, যার ফলে কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তায় মারাত্মক প্রভাব পড়ে।
- ১৯৮৮ সালের লা নিনা: এর প্রভাবে উত্তর আমেরিকা জুড়ে তীব্র খরা দেখা দেয়, যা কৃষিক্ষেত্রে বড় ধরনের ক্ষতি সাধন করে।
- ২০২৩ সালের এল নিনো: সাম্প্রতিক সময়ে একটি শক্তিশালী এল নিনো পরিস্থিতি বিশ্বজুড়ে রেকর্ড ভাঙা উষ্ণতা এবং বিভিন্ন অঞ্চলে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত বা খরা সৃষ্টি করেছে।
জলবায়ু পরিবর্তন এবং এল নিনো-লা নিনা চক্রের সম্পর্ক
জলবায়ু পরিবর্তন এবং এল নিনো-লা নিনা চক্রের মধ্যে সম্পর্ক একটি জটিল বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিষয়। যদিও এল নিনো এবং লা নিনা প্রাকৃতিক ঘটনা, বিজ্ঞানীরা এটি নিয়ে গবেষণা করছেন যে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এই চক্রের তীব্রতা, ফ্রিকোয়েন্সি বা প্রভাবকে কীভাবে প্রভাবিত করছে।
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এল নিনো এবং লা নিনা ঘটনাগুলির তীব্রতা বাড়তে পারে, যা চরম আবহাওয়া পরিস্থিতির প্রকোপ বাড়িয়ে দেবে। উদাহরণস্বরূপ, এল নিনো বছরে বৈশ্বিক তাপমাত্রা আরও বেশি বৃদ্ধি পেতে পারে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট উষ্ণায়নকে আরও ত্বরান্বিত করবে। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, প্রবাল প্রাচীরের ব্লিচিং এবং মেরু অঞ্চলের বরফ গলার মতো ঘটনাগুলোকে প্রভাবিত করতে পারে।
অন্যদিকে, লা নিনা সাময়িকভাবে বৈশ্বিক তাপমাত্রা কমালেও, দীর্ঘমেয়াদী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে পুরোপুরি বাতিল করতে পারে না। সামগ্রিকভাবে, বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন যে এনসো চক্রের আচরণ জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবর্তিত হতে পারে, যার ফলে বিশ্বজুড়ে আবহাওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করা আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠবে।
বৈশ্বিক প্রভাব এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
এল নিনো ও লা নিনার বৈশ্বিক প্রভাব সুদূরপ্রসারী এবং বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি, কৃষি, পানিসম্পদ, স্বাস্থ্য এবং পরিবেশকে প্রভাবিত করে।
- কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা: বিশ্বজুড়ে খাদ্য উৎপাদনে এটি সরাসরি প্রভাব ফেলে। খরাপ্রবণ এলাকায় ফসল উৎপাদন হ্রাস পায় এবং বন্যাপ্রবণ এলাকায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
- পানি সংকট: খরা দীর্ঘায়িত হলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যায়, যা পানীয় জল ও সেচ ব্যবস্থার জন্য বড় হুমকি।
- প্রাকৃতিক দুর্যোগ: বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, দাবানল এবং তাপপ্রবাহের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা ও তীব্রতা বাড়িয়ে দেয়।
- স্বাস্থ্য: তীব্র তাপপ্রবাহ সরাসরি মানুষের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে, বিশেষ করে দুর্বল জনগোষ্ঠীর মধ্যে তাপজনিত অসুস্থতা ও মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়।
- অর্থনীতি: কৃষিভিত্তিক দেশগুলো এল নিনো ও লা নিনার প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়ায় খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ে, যা মুদ্রাস্ফীতিকে প্রভাবিত করে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে:
বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ এবং এটি মৌসুমী বায়ুর উপর অত্যন্ত নির্ভরশীল। এল নিনো এবং লা নিনা বাংলাদেশের আবহাওয়ার উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলতে পারে।
- এল নিনো: এল নিনোর প্রভাবে সাধারণত ভারত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মৌসুমী বৃষ্টিপাত কমে আসে। এর ফলে বাংলাদেশেও বৃষ্টিপাত কম হতে পারে এবং খরা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এটি কৃষি উৎপাদন ব্যাহত করতে পারে এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে তীব্র তাপপ্রবাহের সৃষ্টি করতে পারে, যা জনস্বাস্থ্য ও কৃষিক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
- লা নিনা: লা নিনার প্রভাবে বাংলাদেশে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হতে পারে, যা বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে এটি তীব্র রূপ নিতে পারে এবং নদীগুলোর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটাতে পারে।
যদিও বিজ্ঞানীরা বলছেন যে এল নিনো বা লা নিনার সরাসরি প্রভাব বাংলাদেশের উপর খুব বেশি নাও পড়তে পারে কারণ এটি ভারত ও মিয়ানমার পর্যন্ত প্রভাব ফেলে, তবুও বৈশ্বিক জলবায়ু ব্যবস্থার অংশ হিসেবে এর পরোক্ষ প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। বিশেষত, এল নিনোর সময় ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে বৃষ্টি কম হলে বাংলাদেশেও তার প্রভাব পড়তে পারে।
উপসংহার
এল নিনো ও লা নিনা পৃথিবীর প্রাকৃতিক আবহাওয়া ব্যবস্থার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা বিশ্বজুড়ে জলবায়ুর চরম অবস্থা তৈরি করে। এই দুটি ঘটনা সম্পর্কে সঠিক ধারণা এবং ভবিষ্যদ্বাণী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা এবং ভবিষ্যৎ বিপর্যয় রোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকার, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীগুলোকে এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। উন্নত পূর্বাভাস ব্যবস্থা, কৃষি ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন, পানিসম্পদ সংরক্ষণ এবং দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস কর্মসূচির মাধ্যমে এল নিনো ও লা নিনার সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব কমানো সম্ভব। এই দুটি প্রাকৃতিক শক্তিকে বোঝা এবং তাদের সঙ্গে মানিয়ে চলার কৌশল তৈরি করা এক স্থিতিশীল ভবিষ্যতের জন্য অপরিহার্য।