পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জেনারেল এ কে নিয়াজী: আত্মসমর্পণের পর তার জীবন ও পরিবারের সাক্ষাৎকার

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী। তিনি ছিলেন সেই জেনারেল, যিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। যদিও তার আত্মসমর্পণের পর তাকে নানা রাজনৈতিক এবং সেনা তর্ক-বিতর্কের মধ্যে পড়তে হয়েছিল, তার পরিবারের সদস্যদের কাছে তিনি ছিলেন একজন সাহসী ও দয়ালু ব্যক্তি। শের আফগান খান নিয়াজী, তার ভাতিজা, যিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ব্রিগেডিয়ার পদে কাজ করেছেন, সেই সময়ে তার চাচার জীবন ও কর্মের নানা দিক নিয়ে আলোচনায় বসেন।

নিয়াজীর পাকিস্তানে ফিরে আসা

১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর, যখন ভারতীয় সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) জয় লাভ করে এবং পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়, তখন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান, লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী, এই পরাজয়ের প্রতীক হয়ে ওঠেন। ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসে ভারতীয় সেনাবাহিনী তাকে যুদ্ধ বন্দি হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেছিল। তবে, তার আত্মসমর্পণের পর, পাকিস্তানের রাজনৈতিক এবং সেনা মহলে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। কিন্তু তার পরিবার এবং শের আফগান খান নিয়াজী, যিনি তার ভাতিজা, তাকে একজন ভদ্র এবং সাহসী ব্যক্তি হিসেবে মনে করতেন। শের আফগান নিয়াজী বলেন, “আমরা তাকে দোয়া দিয়েছিলাম যখন তিনি পূর্ব পাকিস্তান থেকে চলে যাচ্ছিলেন, এবং তিনি আমাদের দোয়া করার অনুরোধ করেছিলেন।”

পরিবারের চোখে জেনারেল নিয়াজী

শের আফগান খান নিয়াজী, যিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি কাকুলে ট্রেনিং গ্রহণ করেন, তার পিতার একজন সিনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে নিয়াজীর সাথে সম্পর্ক ছিল। শের আফগান বলেন, “আমাদের পরিবারে কখনোই নিয়াজী জেনারেল সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক ধারণা ছিল না। তিনি আমাদের কাছে একজন সাহসী, দয়ালু এবং ভদ্র ব্যক্তি ছিলেন।” তিনি আরও বলেন, “জেনারেল নিয়াজী, সেনাবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায়, আমাদের পরিবারের সাথে অনেক স্মৃতিপূর্ণ সময় কাটিয়েছেন এবং তিনি আমাদের ওপর সার্বক্ষণিক নজর রেখেছিলেন।”

যুদ্ধের পর জেনারেল নিয়াজীর জীবন

আত্মসমর্পণের পর, জেনারেল নিয়াজী পাকিস্তানে ফিরে আসেন, তবে তার জীবন ছিল একেবারে আলাদা। তিনি সেনাবাহিনীতে আর ফিরে যাননি, বরং তিনি তার নিজের শহরে ফিরে যান এবং অবসর জীবন কাটাতে শুরু করেন। জেনারেল নিয়াজী তাঁর জীবনের বাকি অংশ, বিশেষত ভারতের কারাগারে চার বছর বন্দি থাকার পর, তার লেখালেখিতে সময় কাটিয়েছিলেন। তিনি “দ্য ব্রিটেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান” শীর্ষক একটি বই লিখেছিলেন, যেখানে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ট্র্যাজেডি এবং তার আত্মসমর্পণের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

পূর্ব পাকিস্তান কমান্ডের প্রতি দায়িত্ব

অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার শের আফগান খান নিয়াজী তার পিতার একজন সহযোগী হিসেবে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন, কীভাবে জেনারেল নিয়াজী পূর্ব পাকিস্তান কমান্ডের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তিনি জানান, “১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে যখন পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছিল, তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অনেক সিনিয়র কর্মকর্তা এই কমান্ড নিতে অস্বীকার করেছিলেন। তবে, জেনারেল নিয়াজী, যিনি এই দায়িত্বকে গ্রহণ করেছিলেন, কোনো ধরনের ভয় বা সংশয় ছাড়াই যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন।”

জেনারেল নিয়াজী যোদ্ধা হিসেবে তার সতর্ক দৃষ্টি এবং স্থানীয় প্রতিরক্ষা কৌশল নিয়ে সবসময় আলোচনা করতেন। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং তার প্রভাব সম্পর্কে অনেক কিছু শিখিয়েছিল।

জেনারেল নিয়াজীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও নৈতিক স্খলনের অভিযোগ

যদিও তার পরিবারের সদস্যরা তাকে একজন সাহসী ব্যক্তি হিসেবে মনে করতেন, তবে যুদ্ধ কমিশন তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং নৈতিক স্খলনের অভিযোগ এনেছিল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর পূর্ব পাকিস্তান কমান্ডের শীর্ষ কমান্ডার হিসেবে নিয়াজীকে অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল, এবং তার নেতৃত্বে সেনাবাহিনী কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতির সম্মুখীন হয়েছিল। বিশেষ করে, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল যে তিনি কেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন, এবং কেন পূর্ব পাকিস্তানে তার নেতৃত্বের সময় এত বেশি মানবিক সংকট তৈরি হয়েছিল।

যুদ্ধ কমিশন ১৯৮২ সালে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনে এবং তাকে নৈতিক স্খলনের জন্য দোষী সাব্যস্ত করে। তবে, শের আফগান খান নিয়াজী জানান, “আমি বিশ্বাস করি, যে সিদ্ধান্তগুলি নেওয়া হয়েছিল, তা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের নিরাপত্তার জন্য আবশ্যক, এবং আমার চাচা কখনোই এই সিদ্ধান্তে ভুল করেননি।”

ভারতের কারাগারে বন্দিজীবন

১৯৭১ সালের পর, জেনারেল নিয়াজী ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি হন এবং চার বছর ভারতীয় কারাগারে কাটান। এরপর তিনি মুক্তি পেয়ে পাকিস্তানে ফিরে আসেন, তবে আর সেনাবাহিনীতে ফিরে যাননি। তিনি তার অবসর জীবন কাটাতে লাহোরে অবস্থান করেন, যেখানে তার পরিবার তাকে সমর্থন দিয়ে চলে।

জেনারেল নিয়াজীর পরিবার

জেনারেল নিয়াজী একটি পরিপূর্ণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যার মধ্যে তার দুই ছেলে এবং তিনটি মেয়ে ছিলেন। শের আফগান খান নিয়াজী জানান, তার দুই ভাইই সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন, তবে তারা নিজেদের জীবন ও কর্মকে মুক্তির পরও সহজভাবে গ্রহণ করেছিলেন। তাদের বাবার মতোই, তারা সেনাবাহিনীতে সফলতার সাথে নিজেদের স্থান তৈরি করেছিলেন।

শের আফগান খান নিয়াজীর দৃষ্টিভঙ্গি

শেষমেশ, শের আফগান খান নিয়াজী বলেন, “আমরা আজও বিশ্বাস করি যে, আমাদের চাচা ছিলেন একজন অত্যন্ত সুসজ্জিত, সাহসী এবং বিনয়ী সেনা কর্মকর্তা।” তাঁর ভাষায়, “জেনারেল নিয়াজীকে যখন মানুষ হেয় করার চেষ্টা করেছে, তখন আমরা জানতাম যে সে ছিল একজন দেশপ্রেমিক এবং একমাত্র দেশকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্যই তার কাজ ছিল।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *